ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

৫৮ কোটি টাকায় ‘ইয়াংছা-মানিকপুর-কাকারা-শান্তিবাজার সড়ক’ নির্মাণ ৯ মাসে কাজের অগ্রগতি মাত্র ১৮ শতাংশ!

ক্ষুদ্ধ জনতার প্রশ্ন-কী শুরু করলেন ঠিকাদার?

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া ঃ  ‘ইয়াংছা-মানিকপুর-কাকারা-শান্তিবাজার সড়ক’টির কাজ শুরু করা হয়েছিল ৯ মাস আগে। ভুক্তভোগী লোকজন গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটির যেসব এলাকায় লোকালয় পড়েছে, সেসব অংশের কাজ চলতি বর্ষা মওসুমের আগেই সম্পন্ন করতে পারবে বলে আশায় আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু ঠিকাদারের চরম গাফেলতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে গত ৯ মাসে শুধুমাত্র অফিসিয়ালি ১৮ শতাংশ কাজ করতে পেরেছেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছেন ভুক্তভোগী লোকজন।

জনগুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটির নির্মাণব্যয় হবে ৫৮ কোটি টাকা। এই সড়কটির নির্মাণকাজ শুরুর ৯ মাসে অফিসিয়ালি কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ। যদিও সেই অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের মধ্যে এক মিটার সড়কও কার্পেটিং বা সিসি ঢালাইও হয়নি। কাজের ধীরগতি ছাড়াও সড়কটি ডিজাইন অনুযায়ী তৈরী হচ্ছে না-এমন অভিযোগও মিলেছে।

নির্মাণকাজের মূলসময় শুষ্ক মৌসুমে কাজের গতি দ্রুত থাকার কথা থাকলেও একমাস রাস্তার কিছু কিছু অংশ খুঁড়ে মাঝপথে রেখে রহস্যজনক কারণে উধাও হয়েছিল ঠিকাদার। এতে নিজেদের দায় এড়াতে খোদ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ঠিকাদারকে শোকজ পর্যন্ত করেছিল। এখন বর্ষার আগে এসে আবারও খোঁড়াখুড়ি চালাচ্ছেন ঠিকাদার। এই অবস্থায় কয়েকদফা বৃষ্টি শুরুর পর থেকেই ছিন্নভিন্ন এই সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে লাখো জনগণের চরম দুর্দশা তৈরী হয়েছে। আগামী বর্ষায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা তৈরী হয়েছে জনমনে।

উল্লেখ্য, চকরিয়া উপজেলা সদরের সাথে তিনটি ইউনিয়ন লক্ষারচর, কাকারা এবং সুরাজপুর-মানিকপুর এবং পার্বত্য দুই উপজেলা লামা ও আলীকদমের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করতে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সড়কটি নির্মাণ করছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে সড়কটির নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেও রহস্যজনক কারণে নির্মানকাজে দেরি করে এলাকাবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলছে ঠিকাদার আরএবি আরসি প্রাইভেট লিমিটেড। এর আগেও উদ্বোধনের পর নির্মাণকাজ শুরু না করায় ক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী মানববন্ধনসহ প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছিল।

ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কাকারা ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি অহিদুজ্জামান অহিদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘গতবছর কাজ শুরুর আগে লোকালয়ে থাকা সড়কের অংশ বর্ষার আগে শেষ করার দাবি ছিল সে অনুযায়ী কিছুটা কাজও হয়েছিল। পরে ঠিকাদার এই অংশের কাজ মাঝপথে রেখে পাহাড়ি এলাকার অংশে কাজ শুরু করেছে। ফলে এখন বর্ষা মৌসুমে এখানে এসে আবারও সড়ক খোঁড়াখুড়ির কাজ শুরু করায় দুর্ভোগ তৈরী হয়েছে। এতে সাধারণ জনগণ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছে।’

কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত ওসমান বলেন, মাননীয় এমপি জাফর আলমের চেষ্টায় বিপুল টাকা ব্যয় করে এই সড়ক নির্মাণ করছে সরকার। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার পরও প্রত্যাশিত গতিতে কাজ না হওয়ায় আমাদেরকেই দোষারোপ করছে জনগণ। জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কাজ দ্রুত শেষ করার জনদাবিকেও গুরুত্ব দেয়নি ঠিকাদার। এখন চলতি বর্ষায় চলাচলে কী অবস্থা হবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছি।

প্রকল্প অনুযায়ী, বর্তমানে কাকারা অংশের সড়কটি ১০ ফুট প্রস্থ। একে বাড়িয়ে ১৮ ফুট প্রস্থ করা হবে। এর বাইরে থাকবে চারফুট মাটির অংশ। কিন্তু ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির জিদ্দাবাজার থেকে টোব্যাকো অফিস পর্যন্ত ৪৫০ মিটার অংশ উঁচু করে এবং পাথরের খোয়া দেয়া শেষ হয়েছে চারমাস আগে। এরপর আর কাজ এগোয়নি। এই সড়কের অনেকস্থানেও নির্ধারিত ১৮ ফুট প্রস্থ নেই। কারও বাড়ির দেয়াল, স্কুল-মসজিদের কর্ণারের অংশও ভাঙা হয়নি। শুধু তাই নয়, সড়কের এই অংশে দুটি কালভার্ট আছে যেগুলোর প্রস্থ ১০ ফুট। কালভার্ট দুটিকে বড় করে ১৮ ফুট প্রস্থে করার সিদ্ধান্ত হলেও এখনও অনুমোদন মিলেনি।

কেন এমন হচ্ছে জানতে চাইলে কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, যে পরিমাণ কাজের অগ্রগতি হওয়ার কথা তা হয়নি এবং ঠিকাদারের পারফরমেন্সে আমরাও সন্তুষ্ট নই। কিন্তু লকডাউনের কারণেও খুব বেশি চাপও দেয়া যাচ্ছে না। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

কিন্তু জনবসতি এলাকায় কাজ না করে পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে কাজ করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওটা টেকনিক্যাল এবং ঠিকাদারের বিষয়। তাহলে আপনার কাজ কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রশ্ন না করে ঠিকাদারকে প্রশ্ন করুন।’

প্রকল্পে কাজের বিপরীতে কতটাকা ছাড় হয়েছে, জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘কাজের চেয়েও কম টাকা ছাড় করা হয়েছে। তাদের কাজের পারফরমেন্সে আমরাও সন্তুষ্ট নই। তবে এখন থেকে কাজের গতি দ্রুত করার কথা বলবো। আর আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কাজ শুরুর জোর তাগাদা দেবো। একইসাথে শিগগরিই আমি প্রকল্প এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে সড়কের কাজের অগ্রগতি দেখবো।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আরএবিআরসি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী আশরাফুল আলম আবীর বলেন, ‘করোনাকালীন দুর্যোগ, সেই সময়ে উপকরণ সরবরাহ সংকট, আর্থিক সংকটের কারণে আমাদের কাজের অগ্রগতি কম হয়েছে। একইসাথে কত কিলোমিটার সড়ক সিসি ঢালাই এবং কত কিলোমিটার সড়ক কার্পেটিং হবে তা এখনও চুড়ান্ত হয়নি। এখানে ইচ্ছেকৃত ধীরগতির সুযোগ নেই।’

ইয়াংছা অংশে কাজ শুরুর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কাকারা অংশে ভালো মাটি সরবরাহ না পাওয়ায় শেষপ্রান্ত কাজ করতে গিয়েছি। এখন সেখানেও কাজ করতে গিয়ে আরও জটিলতায় পড়েছি। বনভূমির একটি অংশ অধিগ্রহন করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘১৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে সবচে বেশি দুই লেয়ারের কাজ হয়েছে তিন কিলোমিটারে। সড়কের বাকি অনেক অংশে প্রস্থ করার কাজ শেষ দিকে। আগামী একমাসের মধ্যে কাজের বড় অগগ্রতি এবং দৃশ্যমান হবে।’ এই আশ্বাস দিয়ে একটু ধৈর্য্য ধরারও অনুরোধ করেন তিনি।

এলাকাবাসী বলছেন, ‘একই ঠিকাদার কক্সবাজারে আরো দুটি সড়ক নির্মাণকাজ করছে। সেই প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পের অগ্রগতি মোট ১৮ শতাংশ কেন তা রহস্যজনক। কৌশলে এলাকার লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলার চক্রান্ত কী-না তাও খতিয়ে দেখা উচিত।’ ##

পাঠকের মতামত: